গলা, বুক জ্বালাপোড়া ভাব নিরাময়ের ঘরোয়া দাওয়াই
গলা, বুক জ্বালাপোড়া ভাব, গ্যাস, অ্যাসিডিটির সমস্যা বেশি দেখা যায়। শরীরের ভেতরে চাপা অম্বল হয়ে থাকলেও অনেকে বুঝতে পারেন না। এছাড়াও শীতে অনেকেই গরম পানিতে গোসল করেন, গায়ে জামাকাপড় বেশি থাকে, শাক-ফুলকপি-বাঁধাকপি-সিম এসব বেশি খাওয়া হয়। এখান থেকে সহজেই অ্যাসিড হতে পারে। বিশেষ করে অনিয়মিত খাওয়ার রুটিন, ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবারসহ নানা কারণে অ্যাসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ভোগেন। খাওয়ার ভুল অভ্যাস, ভাজাপোড়া, মশলাযুক্ত বা তৈলাক্ত খাবারের অত্যধিক ব্যবহার, প্রক্রিয়াজাত খাবার, শারীরিক ক্রিয়াকলাপের অভাব, চাপ এবং শরীরে পানির অভাব অ্যাসিডিটির কিছু সাধারণ কারণ। ক্রমাগত অ্যাসিডিটি হতে থাকলে ‘কোয়ালিটি অফ লাইফ’ নষ্ট হয়ে যায়। অনেক বেশি নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। ইচ্ছেমাফিক খাওয়া-দাওয়া করা যায় না। ফলে ওষুধের উপর সারা জীবন নির্ভর করতে হয়। দীর্ঘদিন অ্যাসিড রিফ্ল্যাক্স হলে ফুড পাইপের ক্ষতি হয়। অতিরিক্ত অ্যাসিডিটির কারণে ব্যারেটস ডিজিজ বা ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে।
আমাদের খাদ্যনালী (ইসোফেগাস) খাবার ও পানীয় বয়ে নিয়ে যায় পাকস্থলীতে (স্টমাক)। এই গতিটা নিম্নমুখি – সাধারণ পরিস্থিতিতে উপরের দিকে অ্যাসিডের উঠে আসার কথা নয়। তা খাবার হজম করার জন্য নিঃসৃত হয় এবং পাকস্থলীর দিকেই যায়। আমরা যখন ঢেকুর তুলি, তখনও ভিতর থেকেই হাওয়া উঠে আসে, তবে তাতে তেমন কোনও সমস্যা নেই। এক-আধবার চোঁয়া ঢেকুরও উঠতে পারে। কিন্তু বার বার আপনার খাদ্যনালীতে অ্যাসিড উঠে এলে সেখানে প্রদাহ তৈরি হবে। ফলে বুক জ্বালা করবে, গলা পর্যন্ত টকভাব টের পাবেন। আর তাই গলা, বুক জ্বালাপোড়া ভাব, অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা থাকলে কিছু জিনিস মেনে চলতেই হবে।
অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা যাদের আছে, তারা কখনও পেট ভর্তি করে খাবেন না। খাদ্যনালী যেখানে পাকস্থলীতে মেশে, সেখানে একটি রিং গোছের মাসল থাকে, এই মাসলটির নাম ইসোফেগাল স্পিঙ্কটার। এই পেশিটি দুর্বল হয়ে গেলেই রিফ্লাক্স বেশি হয়। তার উপর অতিরিক্ত খাবার খাওয়াটা ঠিক না – তাতে সমস্যা বাড়বে। সারা দিনে অল্প অল্প করে বার বার খেতে থাকুন, এতে আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণটাও সহজ হবে। ইন ফ্যাক্ট, যারা অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সমস্যায় বার বার ভোগেন, ওজন কমলেই তাদের সমস্যা কমতে আরম্ভ করে। খুব বেশি কার্বোহাইড্রেট খাওয়া বন্ধ করতে পারলেও ভালো হয়। বিশেষ করে ময়দায় তৈরি ভাজাভুজি যত কম খাবেন তত ভালো। অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট হজম করতে সময় বেশি লাগে। তখন পেট ফাঁপে, গ্যাস হয়। জন্ম নেয় ব্যাকটেরিয়া, তার ফলে গ্যাস হয় আরও বেশি।কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেটে সাধারণত সমস্যা হয় না।
যদি কারও হজমের সমস্যা থাকে, তা হলে খাওয়ার রুটিনে ঘন ঘন পরিবর্তন না আনাই ভাল। এ ছাড়াও খাওয়ার পর বসে বা শুয়ে থাকার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারলেও ভাল। খুব ভাল হয় যদি ঘুমোতে যাওয়ার ২ ঘণ্টা আগে খেতে নিতে পারেন। গলা-বুক জ্বালা করলেই ঠান্ডা পানীয় খেলে ফেলা একেবারেই অনুচিত। কারণ, এই জাতীয় পানীয় খেলে ঢেকুর তোলার প্রবণতা বেড়ে যায়। ফলে পাকস্থলীর মধ্যে থাকা অ্যাসিড মুখে উঠে আসতে পারে। বমি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বালিশ ছাড়া ঘুমোনোর অভ্যাসে অম্বলের একটি কারণ হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শোয়ার সময় পা এবং মাথা যেন একই সরলরেখায় না থাকে। মাথার দিক একটু উঁচুতে রাখতেই পরামর্শ দেন তাঁরা। দেহের ওজন বেশি থাকলেও হজমের সমস্যা হতে পারে। বয়স অনুযায়ী ওজন কেমন হওয়া উচিত, তা বুঝেই খাওয়াদাওয়া এবং শরীরচর্চা করলেই অম্বলের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ঘরে-বাইরে নানা কাজের মধ্যে বাড়তে থাকা মানসিক চাপও হজমের গন্ডগোল ঘটাতে পারে। তার উপর যদি ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস থাকে, তা হলে তো সোনায় সোহাগা! মানসিক চাপ কমানোর জন্য প্রাণায়াম, হালকা ব্যায়াম করতে পারেন। আবার ঘর অন্ধকার করে বেশ কিছু ক্ষণ হালকা কোনও গান বা যন্ত্রসঙ্গীতও শুনতে পারেন।
বেশি পরিমাণে কফি, ফলের রস বা সফট ড্রিঙ্ক খেতে অভ্যস্ত যারা, তাদেরও অ্যাসিড রিফ্লাক্সের জটিল সমস্যা দেখা দেয়। এড়িয়ে চলুন কাঁচা পেঁয়াজ, তাতেও বুক জ্বালার সমস্যা বাড়তে পারে। সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে মুখ যেন শুকিয়ে না যায়। লালাগ্রন্থির ক্ষরণ এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ লালাগ্রন্থির ক্ষরণ ভালো হলেই হজম ভালো হবে। হজম ভালো হলে অ্যাসিডের সম্ভাবনা কমে যায়। মাছ, মাংস, ডিম খাদ্যতালিকা থেকে একেবারেই বাদ রাখার চেষ্টা করুন। বন্ধ করতে না পারলে খুবই কম খান। এছাড়াও তেল-মশলা একদম বাদ রাখুন। খুব কম খাবার খান। খিদে না পেলে একেবারেই খাবেন না। লোভ আর চোখের খিদে দূরে রাখুন। গ্যাস, অম্বল থেকেই কিন্তু হতে পারে হার্টের সমস্যাও। তাই সুস্থ থাকতে এড়িয়ে চলুন এই সব খাবার। কিসে আপনার অ্যাসিডিটি দেখা দেয়, সেটা এড়িয়ে চলাই উত্তম। তবে যদি অ্যাসিডিটির সমস্যায় পড়েই যান, তাহলে কিন্তু হাতের নাগালে থাকা অতি সাধারণ কিছু উপাদান আপনাকে এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিতে পারে। প্রতিদিন সকালে উঠে গরম পানিতে দারুচিনি, গোলমরিচ, লবঙ্গ, আদা দিয়ে ফুটিয়ে খান। এতেও শরীর ভালো থাকবে। রাতে একগ্লাস পানিতে মিছরি আর মৌরি ভিজিয়ে রাখুন। পরেরদিন ছেঁকে খান। তাও কিন্তু শরীরের জন্য ভালো।
দুধে সমস্যা না থাকলে এক গ্লাস ঠান্ডা দুধ খান দুপুরের দিকে। পাকস্থলির গ্যাসট্রিক অ্যাসিডকে নিয়ন্ত্রণ করে অ্যাসিডিটি থেকে মুক্তি দেয় ঠান্ডা দুধ। প্রতিদিন একগ্লাস পানির সঙ্গে রয়েকটা আমলকি চিবিয়ে খান। পেটে গ্যাস থাকলে, বদহজম থাকলে খুবই উপকারে আসে আমলকি। প্রতিদিন খাওয়ার পর একটুকরো করে খান। এছাড়াও লবণ দিয়ে আদা চিবিয়ে খান। এতেও কাজ হবে খুব ভালো। কলা একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টাসিড যা পেটের জ্বালা থেকে মুক্তি দিতে পারে। যাদের গরমকালে অ্যাসিডিটির সমস্যা হয়, তারা নিয়মিত কলা খান। নানান ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ তুলসী পাতাও অ্যাসিডিটি দূর করতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি মানসিক ও শারীরিক নানান রোগ দূর করতেও সক্ষম। অ্যাসিডিটি থেকে মুক্তির জন্য তুলসী পাতার ক্কাথ বানিয়ে গরম গরম পান করুন।
অ্যাসিডিটি দূর করার জন্য আদা-পানি খেতে পারেন। অ্যাসিডিটির সমস্যা অনুভব করলেই মুখে সামান্য আদা রেখে নিন। আবার আদা দেওয়া গরম পানি পান করলেও স্বস্তি পাবেন। আদার অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি গুণ অ্যাসিডিটি থেকে স্বস্তি দিতে পারে। এক গ্লাস পানিতে এক চা–চামচ মেথিগুঁড়া মিশিয়ে খেলে অ্যাসিডিটির জ্বালাপোড়া অনেকাংশে কমে। অথবা এক চা–চামচ মেথি দানা এক গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে খালি পেটে সেটা খেলেও উপকার পাওয়া যায়। পেঁপেতে থাকা প্যাপেইন অ্যানজাইম আমাদের হজমপ্রক্রিয়াকে সহজতর করে। ফলে অ্যাসিডিটির মতো সমস্যা হতে পারে না। তাই প্রতিদিনের ডায়েটে রাখতে পারেন দু–এক টুকরা পেঁপে।
জিরা মুখের লালা উৎপাদনে সাহায্য করে যা হজম ও বিপাকে সাহায্য করে। এরফলে গ্যাস ও গ্যাসট্রিক সংক্রান্ত অন্যান্য সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র মতে, পাকস্থলি কোন কারণে উদ্দিপ্ত হলে তা শীতল করতে সাহায্য করে এটি। এ ছাড়া পেটের আলসার দূর করতেও কাজ করে জিরা। অ্যাসিডিটি থেকে মুক্তি পেতে হলে অল্প কিছু জিরা চিবিয়ে খান বা পানিতে ফেলে ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে পান করতে হবে। অ্যাসিডিটির জ্বালাপোড়া, পেট ফাঁপার সমস্যা থেকে বাঁচতে পানি পান করুন প্রচুর পরিমাণে। অ্যাসিডিটি হলে পানি পান করলে পেটের গ্যাস বের হয়ে আসতে পারে এবং অস্বস্তিভাব দূর হয়। আর যদি আপনি নিয়মিত প্রয়োজনীয় পানি পান করেন, তাহলে আপনার অ্যাসিডিটির সম্ভাবনাও কমে যাবে।
সুত্র : ঢাকাটাইমস
সঞ্জু! স্নাতক কোর্স করার পর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন।
৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে লেখক হিসাবে কাজ করছেন।
বর্তমানে তিনি রাজারহাট বার্তা’র সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।